বাংলাদেশের রিজার্ভ কমলো কেন ও তার কারণ | বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়াতে করণীয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমেই চলেছে । সে জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ প্রকাশ করার জন্য চাপ দিচ্ছে । রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকার ও কিছুটা চিন্তিত । প্রধানমন্ত্রী বলেন "যারা এই প্রশ্ন করে রিজার্ভের টাকা গেল কোথায় ? তাদের বলছি রিজার্ভের টাকা গেল পায়রা বন্দরে , এইটাকা কেউ চিবিয়ে খাইনি এইটা মানুষের কাজে লাগছে মানুষের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে । রিজার্ভ কমার জন্য সরকার বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর উন্নয়ন ব্যয়কে দায়ী করলেও অর্থনীতিবিদেরা রিজার্ভার পেছনে আরও বেশ কিছু বিষয়ে চিহ্নিত করেছেন । বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে নিওটেরিক আইটির এই পর্বে ।
বাংলাদেশের রিজার্ভ কমলো কেন ও তার কারণ - বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়াতে করণীয় - Reserve of Bangladesh - NeotericIT.com
করণা মহামারীর মধ্যেই রিজার্ভে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ । মহামারীর ধকল কাটতে না কাটতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ । এর ফলে সংকটে পড়ে গোটা বিশ্ব । তার প্রভাব বাংলাদেশের রিজার্ভ এ পড়েছে । রিজার্ভ নিয়ে এত আলোচনা হলেও রিজার্ভ আসলে কি আমাদের অনেকেরই হয়তো সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই ।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কাকে বলে
প্রথমেই রিজার্ভ কি সে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন । বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি রেমিটেন্স ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে সরকারের ডলার আয় করে তা দিয়ে দেশের আমদানি ভাই এবং ঋণের সুদ সহ যাবতীয় খরচ মেটানোর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ ডলার সঞ্চিত থাকে সেটাই মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ । রিজার্ভ এর সাথে আরেকটি বিষয় ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত । আর তাহলো ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট । যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্য ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট বা লেনদেনের ভারসাম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সাধারণত আমদানি-রপ্তানির আর্থিক হিসেবেই ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট বলা হয় । ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট কে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়
- কারেন্ট একাউন্ট
- ক্যাপিটাল একাউন্ট
কোন দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য জ্বালানি গাড়ি স্বর্ণসহ যাবতীয় আমদানি-রপ্তানির হিসাব টাকে কারেন্ট একাউন্টে অন্যদিকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিনিয়োগ ঋণ এবং ব্যাংকিং তথ্য ক্যাপিটাল একাউন্টের হিসাব করা হয় ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২ বাংলাদেশের অবস্থান
আপনি কি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২ বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চান ? তাহলে নিওটেরিক আইটির এই পেইজের পোস্ট আপনার জন্য ।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ এবং ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট এর বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে । সাধারণত দেশ থেকে পনেরো রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয় সেই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়েই আবার প্রয়োজনীয় পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় । কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার মান অনেক কমে যাওয়ার কারণে পণ্য আমদানি করতে বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে প্রচুর অর্থ খরচ হচ্ছে ।
বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ
বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ কত জানেন ? এই আর্টিকেল থেকেই আপনি একটু পর সব জানতে পারবেন । বাংলাদেশের রিজার্ভ অল্প কিছুদিন আগেও 50 বিলিয়ন ডলার ছিল । সেখান থেকে রিজার্ভ এখন 35 মিলিয়ন এ নেমে এসেছে । অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন রিজার্ভ পতনের এই হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক । বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবীদ ডক্টর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন ঃ
এত দ্রুত রেজাল্ট কমে যাওয়া অবশ্যই চিন্তার বিষয় ।
অর্থনীতিবীদ ডক্টর সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন ঃ
টাকার মান ভয়াবহ ভাবে কমে যাচ্ছে , আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে , জ্বালানি খাদ্য দ্রব্যের উপর প্রভাব পড়ছে । সার্বিক অবস্থা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিচ্ছে । মানুষ তো আসলে ভালো নেই জীবনের মান কমে যাচ্ছে ।
বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ কত ২০২২
বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ কত ২০২২ সালে ? চলতি 2022 - 23 অর্থ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে 489 কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক । গত অর্থবছরে বিক্রি করা হয়েছিল 762 কোটি ডলার । বিকৃত ডলারের 90% খরচ করা হয়েছে জ্বালানি এবং সার আমদানি করার জন্য । গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ছিল চার হাজার 800 কোটি ডলার । বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে 3585 কোটি ডলার । আই এম এফ বলছে বাংলাদেশ রিজার্ভ হিসাব করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করেনা । আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ হিসাব করা হলে 35 মিলিয়ন ডলারেরও অনেক কম হবে । বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ এর অর্থ ডলারের পাশাপাশি বিদেশে বিভিন্ন বন্ড মুদ্রা ও সবর্ণে বিনিয়োগ করে রেখেছে । সবচেয়ে বেশি অর্থ রাখা হয়েছে ডলারে । আবার রিজার্ভ এর অর্থ দিয়ে দেশ ও বেশকিছু তহবিল গঠন করা হয়েছে ।
বাংলাদেশের রিজার্ভ কত বিলিয়ন ডলার
বাংলাদেশের রিজার্ভ কত বিলিয়ন ডলার জানেন ? বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তাদের হিসাবের মোট গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪.৩ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ করা এবং ঋণ হিসাবে দেয়া আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নেট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার
বাংলাদেশের রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলার কিভাবে ? জেনে নিন এই পোস্ট থেকে - রিজার্ভ থেকে 700 কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল । এছাড়া রিজার্ভ এর অর্থ দিয়ে long-term ফান্ড, গ্রীন ট্রানসফর্মেশন ফান্ড এবং বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল নামে আরও বেশ কয়েকটি ফান্ড গঠন । করা হয়েছে পায়রা বন্দর নির্মাণের কাজে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল থেকে অর্থ খরচ করা হয়েছে । সেই সাথে বাংলাদেশের বাজেটেও 82 হাজার 745 কোটি টাকার একটি বিশাল অংকের ঘাটতি রয়েছে । যার সিংহভাগ মেটানো হচ্ছে রিজার্ভ থেকে । এছাড়া বাংলাদেশ বিমান কে উড়োজাহাজ কেনার জন্য এবং সোনালী ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ ধার দেওয়া হয়েছে । সব মিলিয়ে বিভিন্ন তহবিল ও প্রকল্পে রিজার্ভের 8 বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে । এর বাইরে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে 20 কোটি ডলার । খরচ করা এইসব অর্থ রিজার্ভ এর সাথে যোগ করা হয়েছে । আইএমএফ এর পরামর্শ অনুযায়ী এই সকল অর্থ যদি বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে মোট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় 27 বিলিয়ন ডলার ।
বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণ
বাংলাদেশ একটি আমদানি নির্ভর দেশ । আমাদের দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রচুর জিনিস আমদানী করতে হয় । আমদানি করা পণ্য গুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বহু অপ্রোজনীয় পণ্য আছে। বিশেষ করে বিলাস দ্রব্য আমদানি করার কারণে বাংলাদেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় । মূলত এসব বিলাস দ্রব্য আমদানি দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার একটি অন্যতম মাধ্যম । কোন পণ্যের প্রকৃত মূল্য যা তার চেয়ে অনেক বেশি দামে আমদানি দেখিয়ে বাকি টাকা সহজেই বিদেশে পাচার করা যায় । সামগ্রিকভাবে রিজার্ভ কমে যাওয়ার জন্য করনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈষিক পরিস্থিতিকে দায়ী করছে সরকার ।
বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার জন্য দায়ী
অর্থনীতিবিদরা বলছেন বৈশ্বিক পরিস্থিতি কিছুটা দায়ী তো বটেই তবে রিজার্ভ করার ক্ষেত্রে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব বৈশ্বিক পরিস্থিতি চেয়েও বেশি দায়ী । যুদ্ধ হয়তো একসময় শেষ হয়ে যাবে কিন্তু দেশের অর্থ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি দমন করে সুশাসন নিশ্চিত করা না হলে ভবিষ্যতেও এই সমস্যা লেগেই থাকবে ।
বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়াতে করণীয়
বাংলাদেশের রিজার্ভ যে কয়টি বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে তার মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স অন্যতম । রিজার্ভকে সন্তোষজনক অবস্থায় আনতে এই রেমিটেন্স আরো বাড়ানো জরুরি । এর জন্য পরিকল্পিতভাবে বিদেশের শ্রমবাজার বাড়ানোর বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে । অর্থনীতিবিদরা মনে করেন বাংলাদেশে থেকে অনেক বেশি অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে । এই শ্রমিকদেরকে দক্ষ করে বিদেশে পাঠাতে পারলে দ্বিগুণ রেমিটেন্স আয় করা যেত । সাধারণত অন্যান্য দেশের একজন দক্ষ শ্রমিক বাংলাদেশের তিন জন শ্রমিকের সমান আয় করেন । যেহেতু রেমিটেন্স এর উপর দেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল তাই এই খাতকে আরো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে । বাংলাদেশের রিজার্ভ স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে রপ্তানি আয় বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে ।
অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ করতে হবে
বিশেষজ্ঞরা বহুমুখী রপ্তানির কথা বলে আসলেও তৈরি পোশাক খাতের বাইরে অন্য কোন খাতকে সরকারিভাবে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না । রপ্তানিযোগ্য খাতগুলোতে জোর দেওয়ার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ করতে হবে । অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া বাকি সকল বিলাস দ্রব্য আমদানি একেবারে বন্ধ করে দিলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে যাবে না । বাংলাদেশের রিজার্ভ নিয়ে আরেকটি চিন্তার বিষয় হল 2024 সাল থেকে কিছু কিছু স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে । তার মানে সামনের রিজার্ভ এর ওপর আরো চাপ বাড়বে ঋণ যদি সময়মতো পরিশোধ করা না হয় তাহলে সেসব ঋণের সুদ অনেক বেড়ে যাবে । অর্থনীতিবিদদের সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন আমাদের পুরনো কৌশল বাদ দিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে । আমরা উন্নয়ন বলতে শুধুই প্রবৃদ্ধি বুঝে আসছে এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে প্রবৃদ্ধি সত্যিকারের মাপকাঠি নয় । তা এখন বুঝতে পারার কথা বৈষম্য বাড়ছে , গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে , বেকার বাড়ছে , মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে । যাদের সঞ্চয় নেই তারা রাস্তায় বসে যাচ্ছে ।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের আশঙ্কা
আগামী দিনগুলোতে শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং সমগ্র পৃথিবীতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তৈরি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি । এশিয়া আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতে ও মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য সংকট আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে । বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে 2023 সালের সম্ভাব্য খাদ্যঘাটতির আশঙ্কায় নানা ধরনের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে ।