মাইক্রোপ্লাস্টিক কী ? | মানব দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক | বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক | মাইক্রোপ্লাস্টিক সচেতনতা
প্লাস্টিক সর্বপ্রথম আবিষ্কার করা হয়েছিল হাজার ১৮৫০ সালে । আলেকজান্ডার পার্ক নামের একজন বিজ্ঞানী প্লাস্টিক আবিষ্কার করেছিলেন । তাই প্রথমদিকে প্লাস্টিকের নাম ছিল পার্ক যাইন । তার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে । এর মধ্যে প্রায় ৬০০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক সরাসরি আবর্জনায় পরিণত হয়েছে । অর্থাৎ পৃথিবীতে উৎপাদিত প্লাস্টিকের প্রায় ৮০ % বর্জ হিসেবে রয়ে যাচ্ছে ।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কী - মানব দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক - বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক - মাইক্রোপ্লাস্টিক সচেতনতা - Microplastics - NeotericIT.com
প্রতি বছর প্রায় ৮০ লক্ষ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা নদী-নালা-খাল-বিল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে । এখনো পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে তার সব যদি এক জায়গায় জড়ো করা হয় তবে সেই আবর্জনার স্তুপ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও উঁচু হবে । প্লাস্টিক আবর্জনার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ হল মাইক্রোপ্লাস্টিক । আমাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে এবং রক্তে প্রবেশ করে । এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের বুকের দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে । নীরব ঘাতক মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবসভ্যতাকে এক নজিরবিহীন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে । নিওটেরিক আইটির এই পর্বে মাইক্রোপ্লাস্টিক সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কী ?
মাইক্রোপ্লাস্টিক হল প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রতম কণা । সাধারণত ৫ মিলিমিটারের ছোট আকারের প্লাস্টিক কে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় । অর্থাৎ এক ইঞ্চির প্রায় পাঁচ ভাগ ছোট আকৃতির প্লাস্টিক কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয় । তবে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মাইক্রোপ্লাস্টিক গুলো আরো অনেক ছোট হয় । এমন সব অতিক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে , যা খালি চোখে দেখা যায় না । আমাদের সভ্যতা অনেকাংশেই প্লাস্টিক নির্ভর হয়ে পড়েছে । বর্তমানে প্লাস্টিক ছাড়া আপনি চলতেই পারবেননা ।দিনের শুরু থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমরা প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করি । যেখানেই যাবেন সেখানে প্লাস্টিক । পানির বোতল গুলো সব প্লাস্টিকের. । আমাদের বাজারের ব্যাগ প্লাস্টিকের । হোটেল-রেস্তোরাঁ খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে তেল দেওয়া হয় । নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার থেকে শুরু করে মুখরোচক খাবারের প্যাকেট প্লাস্টিকের । প্রতিদিন সকালে ব্যবহার করা টুথপেস্ট শুরু করে ফেসওয়াশ, বডি ওয়াশ , নেইলপলিশের মত প্রসাধনী এবং ডিটারজেন্ট পাউডারের মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে । এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের খাবারের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে । বর্তমানে প্রায় ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে । সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক এ পরিণত হয় । সমুদ্রের অতি ক্ষুদ্র প্রাণী গুলো এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন । এরপর ধীরে ধীরে বড় থেকে বড় মাছ গুলো সেইসব ছোট মাছ গুলোকে খায় , একপর্যায়ে খাদ্য শৃংখল এর ধারাবাহিকতায় সেইসব মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব শরীরে চলে আসে । এত এত প্রাণীর দেহে ঘুরে মানুষের শরীরে আসলেও কোন প্রাণীর পাকস্থলীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক হজম হয়না । সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও সামুদ্রিক পাখির পেটে যাচ্ছে মাইক্রো প্লাস্টিক। প্লাস্টিক বা মাইক্রো প্লাস্টিক অনেক প্রানির গলায় আটকে মারাও যাচ্ছে । ২০১৮ সালে স্পেনের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় একটি তিমির মৃতদেহ ভেসে এসেছিল । সেই তিমিতে প্রায় ৩২ কেজি প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল । বিশেষ কতগুলো জায়গায় অধিকহারে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায় । সেই জায়গা গুলোর মধ্যে স্পেনের উপকূল, চীনের ইয়াংসি নদী, অস্ট্রেলিয়ান মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এবং যুক্তরাজ্যের নদ-নদীগুলো উল্লেখযোগ্য ।
মানব দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে সারাদিন ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের রক্তে মিশে যাচ্ছে । এছাড়া আমাদের ফুসফুসেও অনেক মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে যা মানুষের শরীর থেকে নিঃশ্বাস হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই । মানুষের শরীরে যত মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলেও পিইটি প্লাস্টিক । সাধারণত পানির বোতল গুলো এই ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয়। এর পরেই পলিস্টারিন জাতীয় প্লাস্টিক মানব শরীরের সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী প্যাকেজিং করতে এ ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় এবং মানব রক্ত পাওয়া অন্যতম আরেক ধরনের প্লাস্টিক হল পলিথিন । এই উপাদান আমরা সবাই চিনি পলিথিন দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ বানানো হয় । বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক এমন সব রাসায়নিক নিঃসরণ করে যার এস্ট্রোজেনিক অ্যাক্টিভিটি আছে । অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কনা মানব শরীরে প্রবেশ করে এস্ট্রোজেন হরমোনের মতো কাজ করতে শুরু করে । এই বিষয়টি এস্ট্রোজেন অ্যাক্টিভিটি হিসেবে পরিচিত । বেশিরভাগ প্লাস্টিক সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসার পর এস্ট্রোজেনিক অ্যাক্টিভিটি তৈরি হয় । আমেরিকার ৯২ শতাংশ মানুষের শরীরে এই ধরনের ক্ষতিকারক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে । ১১ বছরের কম বয়সী শিশুদের দেহে এই ক্ষতির মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ । এছাড়া মানব দেহে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপর বিভিন্ন ক্ষতিকর অনুজীব বাসা বাঁধার সুযোগ পায় । মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে থাকা হরমোনের নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে । এ ছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় । মাইক্রো প্লাস্টিক দূষণ একেবারেই নতুন একটি বিষয় । তাই এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এখনো হয়নি। সে কারণেই ক্ষতিকর উপাদান মানব শরীরের জন্য কি কি ধরনের হুমকি নিয়ে আসতে পারে তার সঠিক ধারণা করা মুশকিল । তবে প্লাস্টিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে যে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তা থেকেই বোঝা যায় এই উপাদান মানব শরীরে কেমন ক্ষতি করতে পারে ।
বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক
মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের দুই দল গবেষক বেশ কিছু গবেষণা করেছেন । বাংলাদেশের খাবার লবণ এবং চিনি নিয়ে পৃথক দু'টি গবেষণা উল্লেখযোগ্য। দেশের নামকরা দশটি ব্যান্ডের লবণসহ স্থানীয় দোকান থেকে খোলা লবন এর নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা চালানো হয় । প্যাকেটজাত এবং খোলা উভয় লবনে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক রয়েছে । প্রতি কেজি সামুদ্রিক লবণ ৩৯০ থেকে ৭৪০০ আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে । এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি । বঙ্গোপসাগর থেকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবার লবনের পলিস্টিরিন ইথিলিন, ভিনাইল এসিডেট , পলিথিন নাইলন, পলিথিন টেরেপ্তেরালের মতো প্লাস্টিক উপাদান পাওয়া গেছে । আরেকটি গবেষণায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চিনি আশঙ্কাজনক মাত্রায় ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। শুধুমাত্র চিনির মাধ্যমে প্রতিবছর বাংলাদেশের মানুষের শরীরে ১০ টনের ও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক এর কণা প্রবেশ করতে পারে । এছাড়া পাঁচটি ব্রেন্ডের টি ব্যাগের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় পলিটেট্রাফ্লুটো ইলিথিন, হাইডেন্সিটি পলিথিন, পলিকার্বনেট , পলিভিনাইল ক্লোরাইড, নাইনল ইথিনিল ভিনাইল অ্যাসিটেড, সেলুলস এসিটেড এবং এভিএস এর মত প্লাস্টিক কণা রয়েছে। শুধুমাত্র তিনটি ভোগ্যপণ্যে এই অবস্থা। বাজার এর সকল খাদ্য পণ্য নিয়ে গবেষণা করলে কেমন ভয়াবহ চিত্র উঠে আসবে তা সহজেই অনুমেয়। এসব খাদ্যপণ্য থেকে এত ভয়াবহ মাত্রায় প্লাস্টিক আমাদের রক্তে মিশে যাচ্ছে যে সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের দুধেও মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে
মাইক্রোপ্লাস্টিক সচেতনতা
বিশ্বের সকল প্লাস্টিক পণ্যের ৮০% ই-বর্জ্য হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণ করছে । এছাড়া ১২% প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হয় সেটিও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর । এবং বাকি মাত্র ৮ % প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল করা হয় । ২০১৪ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে প্লাস্টিক দূষণে শীর্ষ ১০ পরিবেশগত সমস্যার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় । মাইক্রোপ্লাস্টিক সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে ২০১৫ সালের জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে মাইক্রোপ্লাস্টিক গবেষণাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । যেহেতু প্লাস্টিক ছাড়া আমার চলেই না তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো এমন উন্নত ধরনের প্লাস্টিক উৎপাদন করতে হবে যাতে মাইক্রো প্লাস্টিক দূষণ কম হয়। এছাড়া প্লাস্টিক পণ্যের রিসাইকেলিং এর উপর জোর দিতে হবে। প্লাস্টিক দূষণ লোকচক্ষুর অন্তরালে ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে চলছে । তাই এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে । একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য বর্জন করতে হবে । মাইক্রোপ্লাস্টিক এর মতই এক নিরব মহামারি আমাদেরকে গ্রাস করছে । ভয়ঙ্কর এই মহামারীর নাম এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স । অর্থাৎ আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক আর আগের মতো কাজ করছে না । অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এর কারণে পরোক্ষভাবে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মারা যাচ্ছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি ? এবং এই বিষয়টি কিভাবে আমাদের এক নিরব মহামারি'র দিকে নিয়ে যাচ্ছে ? সে সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের নিওটেরিক আইটির এই আর্টিকেলটা পড়তে পারেন ।