হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি | হোমিওপ্যাথির ইতিহাস | হোমিওপ্যাথির মূলনীতি | বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথি

প্রিয় বন্ধুরা আজকের এই আর্তিকেলের মাধ্যমে আমরা নিওটেরিক আইটি থেকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি - হোমিওপ্যাথির ইতিহাস -  হোমিওপ্যাথির মূলনীতি -  বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথি - Homeopathy treatment method  সম্পর্কে ।  যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে নানান ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে .  এলোপ্যাথিক,  হোমিওপ্যাথি আয়ুর্বেদিক , ইউনানী,  আকুপাংচার ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতি তার মধ্যে অন্যতম ।

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি - হোমিওপ্যাথির ইতিহাস -  হোমিওপ্যাথির মূলনীতি -  বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথি - Homeopathy treatment method - NeotericIT.com


বর্তমান সময়ে আধুনিক চিকিৎসার বাইরে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিকল্পধারার চিকিৎসা হলো হোমিওপ্যাথি।  অনেকেই হোমিওপ্যাথিকে  সবচেয়ে কার্যকরী এবং সেরা চিকিৎসা হিসেবে দাবি করে । অন্যদিকে অধিকাংশ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানী হোমিওপ্যাথি কুসংস্কার এবং ভাঁওতাবাজি হিসেবে উড়িয়ে দেয়।  হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মূলনীতি গুলো কি কি ? এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কি আসলেই কার্যকরী সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে নিওটেরিক আইটির এই আর্টিকেলে । 

হোমিওপ্যাথির ইতিহাস

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ১৭৯৬  সালে জার্মান বিজ্ঞানী স্যামুয়েল হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন।  হ্যানিম্যান প্রথাগত ডাক্তারি পড়া শেষ করে ১৭৭৯ সালে চিকিৎসা শুরু করেন । কিন্তু সেই আমলের চিকিৎসাপদ্ধতি এখনকার মতো এতটা উন্নত ছিল না । রোগীর শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়ে কিংবা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে চিকিৎসা দেয়া হতো । সে কারণে হ্যানিম্যান এই পেশায় খুব বেশি স্বস্তি পারছিলেননা । হ্যানিম্যান আত্মজীবনীতে লেখেন সময় তার নিজেকে অচেনা রোগীদের খুনি বলে মনে হচ্ছিল । এক পর্যায়ে তিনি চিকিৎসা বাদ দিয়ে রসায়নের চর্চা এবং বই লেখা ও অনুবাদ করে সময় কাটাচ্ছিলেন । সেই সময় থেকেই তিনি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন । ১৮০৭ সালে স্যামুয়েল হ্যানিম্যান তার লেখা একটা বইতে সর্বপ্রথম হোমিওপ্যাথি শব্দটি ব্যবহার করেন । তখন তিনি প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন।  সে সময় মূল ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার কোন নাম ছিল না । সমালোচনা করার সময় এনিমেল প্রচলিত চিকিৎসার নাম দেন অ্যালোপ্যাথি । প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে তৈরি হওয়া সেই চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত এলোপ্যাথি নামে পরিচিত হয়ে আসছে।  তবে বর্তমান সময়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এলোপ্যাথি নামটাতে আপত্তি জানান । তাঁরা মনে করেন হ্যানিম্যানের সময় অনেকটা অনুমাননির্ভর চিকিৎসা করা হলেও বর্তমানে মূল ধারার চিকিৎসাব্যবস্থা বিজ্ঞানভিত্তিক এবং প্রমাণ নির্ভর । তাই এলোপ্যাথির বদলে বর্তমান চিকিৎসকরা একে মর্ডান মেডিসিন বা আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে পরিচয় করাতে চান । 

হোমিওপ্যাথির মূলনীতি

হ্যানিম্যান প্রাচীন চিকিৎসকদের কয়েকটি চিকিৎসা নীতির উপর নির্ভর করে হোমিওপ্যাথিক সূত্রপাত করেছিলেন।  হোমিওপ্যাথি মূলত সাতটি মূলনীতির ওপর পরিচালিত হয় । সেগুলো হলো 

  • ল অফ সিমিলিয়া
  • ল অফ সিমপ্লেক্স 
  • ল অফ মিনিমাম
  • ডকট্রিন অফ ড্রাগ প্রুভিং
  • থেওরি অফ ক্রনিক ডিজিস
  • থেওরি অফ ভাইটাল ফোর্সেস 
  • ডকট্রিন অফ ড্রাগ ডাইজেশন 

এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তথ্যটি হলো ল অফ সিমিলিয়া । এর মূলমন্ত্র হলো - স্বদ্রিশ স্বদেশের উপসব করে ।  অর্থাৎ যার কারণে রোগ সৃষ্টি হয় সেই ধরনের উপাদান দিয়ে এই রোগ নিরাময় করা যায়।  অনেকটা বাংলা প্রবাদ এর মত - বিষে বিষেক্ষয় এর মতো  । বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই সূত্র ধরেই হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি ধারা প্রবর্তন করেন । এরপর ল অফ সিমপ্লেক্স অনুসারে মনে করা হয় একটি রোগের শুধুমাত্র একটি ঔষুধি কার্যকর । একাধিক ওষুধের প্রয়োজন নেই । ল অফ মিনিমাম অনুযায়ী সঠিক নুন্যতম পরিমানে ব্যবহার করার কথা বলা হয় । ওষুধের মাত্রা যত কম হবে তত বেশি কার্যকর হবে । ওষুধের মাত্রা বেশি হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা । ডকট্রিন অফ ড্রাক টেস্ট্রিং অনুসারে একটি ঔষুধ একাধিক সুস্থ ব্যক্তির উপর বারবার প্রয়োগ করে রোগের লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তবেই ঔষধটি কার্যকর হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয় । যে কোন মানুষ এই সংক্রান্ত নির্দেশাবলী অনুসরণ করে নিজের উপর ঔষধের পরীক্ষা চালাতে পারেন । থেওরি অফ ক্রনিক ডিজিস মতে  কিছু অসুখ একান্তই কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কে ধীরেধীরে আক্রমণ করে । তাই তার ক্ষেত্রে চিকিৎসায় সেই ব্যক্তির মতো আলাদা হতে হবে । থেওরি অফ ভাইটাল ফোর্সেস তত্তে   জীবনীশক্তির কথা বলা হয়েছে । যার কারণে কোনো জীবিত জীব বেঁচে থাকে । এই জীবনীশক্তি ক্ষতিকর উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হলেই মানুষ অসুস্থ হয়ে যায় । মানসিক শারীরিক এবং পারিপার্শ্বিক ক্ষতিকর উপাদান অনুযায়ী এর চিকিৎসার ধরন ভিন্ন হয় । থেওরি পফ ড্রাক ডাইনামাইজেশন তত্তে ব্যবহারযোগ্য ঔষধের প্রকার নিয়ে গবেষণা করা হয় । প্রাণীজ  উদ্ভিদজ  মৌলিক ও যৌগিক লবন ,  এসিড ও ক্ষার এমনকি সুস্থ-অসুস্থ প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহ থেকে নেওয়া উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করা হয় । 

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি - হোমিওপ্যাথি ওষুধ

হোমিওপ্যাথির কথা শুনলেই ছোট সাদা গোল গোল ওষুধের কথা মাথায় আসে । এগুলো আসলে চিনির বল , এর সাথে বিভিন্ন ধরনের উপাদান মিশিয়ে ঔষধ হিসেবে সেবন করা হয়।  এই ওষুধ প্রস্তুত এবং প্রয়োগের পদ্ধতিটি হোমিওপ্যাথির সবচেয়ে সমালোচিত বিষয় । হ্যানিম্যানের একবার  সিঙ্কোনা গাছের বাকল খেয়ে ছিলেন । যা তৎকালীন সময়ে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হত । সিঙ্কোনা বাকল খাওয়ার পর হ্যানিম্যানের শরীরে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ দেখা যায় । সেই থেকে তিনি ধারণা করেন যে উপাদান রোগের লক্ষণ তৈরি করে , সেই উপাদান এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায় । যে জিনিস অধিক পরিমাণ গ্রহণ করলে মানুষ অসুস্থ হয়,  সেই জিনিস অল্প করলে মানুষ সুস্থ হয়ে যায় । তাই হোমিওপ্যাথিতে কোন মূল উপাদান কে পানি অথবা অ্যালকোহলের দ্রবীভূত করার পর পাতলা করে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় । এই দ্রবীভূত ওষুধের মাত্রা এত হালকা হয় যে সেই ওষুধের আদৌ কোনো কার্যকরী উপাদান থাকে কিনা সন্দেহ।  যেমন কোন ওষুধের একফোঁটা নির্যাস নিয়ে নয় ফোঁটা পানির সাথে মেশানো হয় । এরপর আবার সেই মিশ্রণ থেকে এক ফোঁটা নিয়ে আর নয় ফোঁটা পানির সাথে মেশানো হয় । এভাবে ১০০ বার পর্যন্ত ঔষধ থেকে পাতলা করা হতে পারে।  সর্বশেষ পাত্রে যে মিশ্রণ থাকে তাতে আদো  মূল ঔষদের কোন নির্জাস থাকে কিনা সন্দেহ । সাধারনত ১৩ বার কোন ওষুধ পাতলা করলেই তাতে আর  মূল উপাদান থাকে না । হ্যানিম্যানের সময় পদার্থের অনু পরমানুর ধারনা খুব বেশি উন্নত হয়নি । তাই তিনি নিজের মন মত এই কাজটি করেছেন । কিন্তু বর্তমানে পদার্থ ও রাসায়নিক বিদ্যা অনেক অগ্রসর হলেও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকেরা  এই বিষয়টিকে এখনো যথার্থ বলে মনে করেন । শুধু তাই নয় হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করা হয় কোন মিশ্রণে প্রথমে যে উপাদান মেশানো হয়েছিল পানি  তার গুনাগুন মনে রাখতে পারে । যদিও আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না । 

হোমিওপ্যাথির সমালোচনা

হোমিওপ্যাথি ওষুধের সত্যিকারের রোগ সারানোর মতো কোনো উপাদান আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে । ইউএস ন্যাশনাল হেলথ ইন্সটিটিউট বলেছে হোমিওপ্যাথির কয়েকটি মূলমন্ত্র রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় । কিন্তু তারপরও কেন হোমিওপ্যাথি অনেকক্ষেত্রেই কাজ করে । হোমিওপ্যাথিতে কি এমন আছে যার কারণে অনেক মানুষ এখনও এই পদ্ধতির চিকিৎসায় সন্তুষ্ট।  বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি নিয়েও গবেষণা করেছেন ২০১৫  সালে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল হেলথ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা নিয়ে ২০০ টি পরীক্ষা করেছে।  সবগুলো পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে তারা বলেন হোমিওপ্যাথি আসলে এক ধরনের প্লাসিবো । প্লাসিবো হল এমন এক ধরনের মানসিক অবস্থা , যার ফলে মিথ্যা ওষুধ সেবন করে ও মানুষ সুস্থ হয়ে যায় । অনেক সময় মানুষ বিভিন্ন উদ্ভট জিনিস দিয়ে চিকিৎসা করে এবং মনে করে এই জিনিসটার রোগ ভালো হয়ে যাবে । সেই জিনিসের সারানোর মতো কোনো উপাদান না থাকলেও দেখা যায় সত্যি সত্যি তার রোগ ভালো হয়ে গেছে । যেমন ভারতের অনেক মানুষ গোমূত্র রোগের ঔষধ হিসেবে মনে করে মানুষের বিশ্বাসের সাথে রোগ নিরাময়ের এই বিষয়টিকে বলা হয়েছে প্লাসিবো ইফেক্ট ।  অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা বলেন হোমিওপ্যাথিতে এমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই যা রোগ সারাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে । আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার অনুমোদন দেয় না । এমনকি হ্যানিম্যান এর জন্মস্থান জার্মানিতেও কোন বাবা-মা যদি তার সন্তানকে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে বাইরে রেখে জোর করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করায় সে ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বাবা-মায়ের শাস্তি হতে পারে । 

বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি

প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা চলে আসছে।  ব্রিটিশ শাসনামলে অ্যালোপ্যাথি প্রচলন করার চেষ্টা করা হলেও উপমহাদেশের মানুষ সহজে তা গ্রহণ করতে যায়নি । তবে ১৮০০  সালের দিকে গুটি বসন্তের টিকা সেই অবস্থা অনেকটাই বদলে দেয়।  তারপর থেকে অ্যালোপ্যাথি ভারতীয় উপমহাদেশে একটু একটু করে বিস্তার লাভ করতে থাকে । তবে হোমিওপ্যাথির যাত্রা অনেক পরে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ভারতে হোমিওপ্যাথি বিস্তার লাভ করতে থাকে ।  বাংলাদেশের সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ এর তথ্য মতে বর্তমানে দেশের ২৮  শতাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথি এবং ইউনানী চিকিৎসা গ্রহণ করেন । শুধুমাত্র ২০১৮  সালের হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে প্রায় ৪৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে । এবং ৫১০  জন রোগী দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণে হোমিওপ্যাথি হাসপাতালে ভর্তি ছিল । এছাড়া দেশের বাকি ৬০টি  হোমিওপ্যাথি কলেজ ও হাসপাতাল সহ বহু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কার্যালয়ে অসংখ্য রোগীর চিকিৎসায নে ।  হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা মনে করেন  কম খরচ আর পার্শপ্রতিক্রিয়াহীন হওয়ার কারণে অনেকেই হোমিওপ্যাথির উপর নির্ভর করেন ।এলোপ্যাতি চিকিৎসকরা বলেন অনেক সময় দেখা যায় ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হবার পরও মানুষ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করার ফলে রোগ শেষ পর্যায়ে চলে যায় । তখন আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীর আর কোনো উন্নতি হয় না । সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হয়তো কোনো সমস্যা হয় না।  কিন্তু মারাত্মক কোন রোগে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা বাদ দিয়ে হোমিওপ্যাথি গ্রহণ করলে শেষ পর্যন্ত রোগীর ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url